মানুষের কানের জটিল রোগসমূহঃ কারণ, লক্ষণ, এবং প্রতিকার

কান আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা শুধু শোনার কাজই করে না বরং শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কানের যে কোনো সমস্যা শুধু শোনার ক্ষমতাকেই প্রভাবিত করে না, অনেক সময় এটি মানসিক চাপ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, এমনকি কর্মক্ষমতাও হ্রাস করতে পারে।

এই নিবন্ধে আমরা কানের বিভিন্ন জটিল রোগ, তাদের কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

কানের গঠন এবং এর ভূমিকাঃ

কানকে প্রধানত তিনটি অংশে ভাগ করা হয়:

  1. বহিঃকর্ণ (Outer Ear): এটি কান ও কানপথ নিয়ে গঠিত এবং শব্দ তরঙ্গ সংগ্রহ করে।
  2. মধ্যকর্ণ (Middle Ear): এটি কানপট ও তিনটি ছোট হাড়ের মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গকে প্রক্রিয়াকরণ করে।
  3. অন্তঃকর্ণ (Inner Ear): এটি শব্দকে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে এবং শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে।

কানের যে কোনো একটি অংশে সমস্যা হলে সেটি শোনার ক্ষমতা এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে।

WWW.INSTAHEADLINE.COM 21

কানের জটিল রোগসমূহঃ

১. মেনিয়ার্স রোগ (Ménière’s Disease)

মেনিয়ার্স রোগ হলো অন্তঃকর্ণের একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং গুরুতর সমস্যা, যা সাধারণত একক কানে ঘটে।

কারণঃ

অন্তঃকর্ণে তরলের অস্বাভাবিক চাপ বা প্রবাহ।

জিনগত প্রবণতা।

ভাইরাল সংক্রমণ বা অটোইমিউন রোগ।

লক্ষণঃ

হঠাৎ ভারসাম্যহীনতা বা মাথা ঘোরা (Vertigo)।

কানে ক্রমাগত আওয়াজ (Tinnitus)।

শুনতে সমস্যা বা আংশিক বধিরতা।

কানে চাপ বা পূর্ণতার অনুভূতি।

প্রতিকারঃ

লবণ এবং ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা।

ডাইইউরেটিক ওষুধ গ্রহণ।

ভারসাম্য থেরাপি।

গুরুতর ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসা।

২. ওটাইটিস মিডিয়া (Otitis Media)

ওটাইটিস মিডিয়া হলো মধ্যকর্ণের সংক্রমণ, যা শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

কারণঃ

ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণ।

সর্দি-কাশি থেকে মধ্যকর্ণে প্রদাহ।

কান পরিষ্কার না করার ফলে জমে থাকা ময়লা।

লক্ষণঃ

কান ব্যথা এবং চাপ।

কানে পূঁজ বা তরল নির্গত হওয়া।

শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস।

জ্বর এবং অস্থিরতা।

প্রতিকারঃ

এন্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ।

ঘরোয়া চিকিৎসা হিসেবে গরম সেঁক।

শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে নল বসানো (Tympanostomy tubes)।

৩. টিনিটাস (Tinnitus)

টিনিটাস হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে রোগী কানে ক্রমাগত বাজে আওয়াজ বা গুঞ্জন শুনতে পান। এটি অনেক সময় মানসিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কারণঃ

দীর্ঘ সময় উচ্চ শব্দে থাকা।

কানের স্নায়ুর ক্ষতি।

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

মানসিক চাপ বা রক্তচাপের সমস্যা।

লক্ষণঃ

কানে গুঞ্জন, হুইসেল বা সিসকার মতো শব্দ।

একটানা শব্দ শোনার কারণে ঘুমের ব্যাঘাত।

মনোযোগের ঘাটতি।

প্রতিকারঃ

শব্দ থেরাপি বা কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি।

হিয়ারিং এইডের ব্যবহার।

মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন।

৪. অ্যাকুস্টিক নিউরোমা (Acoustic Neuroma)

এটি অন্তঃকর্ণের স্নায়ুতে বেনাইন টিউমার (অক্ষতিকারক টিউমার) তৈরি হওয়ার কারণে ঘটে।

কারণঃ

নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি, তবে জিনগত কারণ বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

লক্ষণঃ

এক কান দিয়ে শুনতে সমস্যা।

মাথা ঘোরা এবং ভারসাম্যহীনতা।

মাথায় চাপ অনুভব।

প্রতিকারঃ

শল্যচিকিৎসা বা রেডিওথেরাপি।

নিরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ।

৫. সেন্সোরিনিউরাল বধিরতা (Sensorineural Hearing Loss)

এই ধরনের বধিরতা অন্তঃকর্ণ বা শ্রবণ স্নায়ুর ক্ষতির কারণে ঘটে।

কারণঃ

বয়সজনিত ক্ষয় (Presbycusis)।

উচ্চ শব্দের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।

মাথায় আঘাত।

লক্ষণঃ

হঠাৎ বা ধীরে ধীরে শ্রবণ ক্ষমতা হারানো।

কানে আওয়াজ শোনা।

কথোপকথনে অসুবিধা।

প্রতিকারঃ

হিয়ারিং এইড ব্যবহার।

ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট।

শব্দ থেরাপি।

৬. বারোট্রোমা (Barotrauma)

বারোট্রোমা হলো কানের উপর চাপের পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যা।

কারণঃ

প্লেনে ওঠা বা নামা।

ডাইভিং বা স্কুবা ডাইভিং।

মধ্যকর্ণে জমাট বাঁধা তরল।

লক্ষণঃ

কান ব্যথা।

শুনতে সমস্যা।

কানে পূর্ণতার অনুভূতি।

প্রতিকারঃ

চিউইং গাম বা হাই তোলা।

ডিকনজেস্টেন্ট ওষুধ।

গুরুতর ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসা।

কানের রোগ প্রতিরোধে করণীয়ঃ

কানের জটিল রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  1. শব্দ দূষণ এড়ানোঃ উচ্চ শব্দে দীর্ঘক্ষণ থাকার অভ্যাস পরিবর্তন করুন।
  2. কানের সঠিক পরিচর্যাঃ কানে ময়লা জমতে না দেওয়া এবং শক্ত বস্তু ব্যবহার না করা।
  3. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনঃ সুষম খাদ্যগ্রহণ এবং মানসিক চাপ কমানোর অভ্যাস গড়ে তোলা।
  4. প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহারঃ সাঁতার বা ডাইভিংয়ের সময় ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার।
  5. নিয়মিত চেকআপঃ বছরে অন্তত একবার কানের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো।

উপসংহারঃ

কানের জটিল রোগসমূহ কখনো কখনো স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কানের প্রতি যত্নশীল থাকা এবং সচেতনতা অবলম্বন করলে অনেক জটিল সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

Scroll to Top