শ্বাসনালী মানুষের শ্বাসযন্ত্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ফুসফুসের সঙ্গে বাইরের পরিবেশের সংযোগ স্থাপন করে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারা আমাদের শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে, যা জীবনের জন্য অপরিহার্য। এই নিবন্ধে আমরা শ্বাসনালীর গঠন, কার্যপ্রণালী, সাধারণ রোগসমূহ, চিকিৎসা ও শ্বাসনালীর যত্ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
শ্বাসনালীর গঠন ও কাঠামোঃ
শ্বাসনালী মূলত তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিতঃ
- নাসিকা ও নাসিকা গহ্বর – এটি বাতাস গ্রহণের প্রাথমিক প্রবেশপথ।
- শ্বাসনালী (ট্রাকিয়া) – নাক থেকে নেওয়া বাতাস ফুসফুসে পৌঁছানোর জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।
- ব্রংকাস ও ব্রংকিওলস – ট্রাকিয়া থেকে বাতাস বিভক্ত হয়ে ফুসফুসের বিভিন্ন অংশে যায়।
১. নাসিকা ও নাসিকা গহ্বর
নাকের ভেতরে ছোট ছোট চুল এবং শ্লেষ্মা থাকে, যা বাতাসের ধূলিকণা, জীবাণু ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান আটকায়। এটি বাতাসকে আর্দ্র করে এবং শ্বাসগ্রহণের উপযোগী করে তোলে।
২. শ্বাসনালী (ট্রাকিয়া)
ট্রাকিয়া একটি নলাকার গঠন, যা কার্টিলেজের দ্বারা সুরক্ষিত। এটি প্রায় ১০-১২ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট হয়। ট্রাকিয়া ফুসফুসে অক্সিজেনসমৃদ্ধ বাতাস পৌঁছাতে সাহায্য করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করে।
৩. ব্রংকাস ও ব্রংকিওলস
ট্রাকিয়া দুটি প্রধান ব্রংকাসে বিভক্ত হয়, যা পরে ছোট ছোট ব্রংকিওলসে বিভক্ত হয়ে ফুসফুসের আলভিওলাই পর্যন্ত পৌঁছায়। এখানে গ্যাস আদান-প্রদানের মাধ্যমে অক্সিজেন রক্তে প্রবেশ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয়ে আসে।
শ্বাসনালীর কার্যপ্রণালীঃ
শ্বাসনালীর প্রধান কাজ হলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের অক্সিজেন গ্রহণ করা এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বের করা। এই প্রক্রিয়াটি দুটি ধাপে সম্পন্ন হয়ঃ
- ইনহেলেশন (শ্বাস গ্রহণ) – বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং অক্সিজেন রক্তে মিশে যায়।
- এক্সহেলেশন (শ্বাস ত্যাগ) – কার্বন ডাই অক্সাইড ফুসফুস থেকে বের হয়ে যায়।
শ্বাসনালীতে সিলিয়া নামক ছোট ছোট চুল থাকে, যা ধূলিকণা ও জীবাণু ফুসফুসে প্রবেশ করতে বাধা দেয়।

শ্বাসনালীর সাধারণ রোগ ও সমস্যাঃ
শ্বাসনালী বিভিন্ন সংক্রমণ ও রোগে আক্রান্ত হতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ সমস্যা আলোচনা করা হলোঃ
১. অ্যাজমা (Asthma)
অ্যাজমা শ্বাসনালীর একধরনের প্রদাহজনিত রোগ, যা শ্বাসনালী সংকুচিত করে এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সাধারণত ধুলো, ধোঁয়া বা অ্যালার্জির কারণে এটি হতে পারে।
২. ব্রঙ্কাইটিস (Bronchitis)
এই রোগটি শ্বাসনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং অতিরিক্ত শ্লেষ্মা উৎপন্ন হয়। ব্রঙ্কাইটিস দুই ধরনের হতে পারেঃ
অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিস – সাধারণত ভাইরাসের কারণে হয়।
ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস – দীর্ঘমেয়াদি ধূমপান বা দূষণের কারণে হয়।
৩. নিউমোনিয়া (Pneumonia)
নিউমোনিয়া মূলত ফুসফুসের সংক্রমণ, তবে এটি শ্বাসনালীকেও প্রভাবিত করতে পারে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের সংক্রমণের ফলে এটি হয়ে থাকে।
৪. টিউমার ও ক্যানসার
শ্বাসনালীতে টিউমার বা ক্যানসার দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি বেশি।
৫. ট্র্যাকিয়াল স্টেনোসিস
এটি শ্বাসনালীর সংকোচনজনিত একটি সমস্যা, যা সাধারণত ট্রমা বা দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহের কারণে ঘটে।
শ্বাসনালীর যত্ন ও সুস্থতা বজায় রাখার উপায়ঃ
শ্বাসনালীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর উপায় অনুসরণ করা যেতে পারেঃ
১. ধূমপান পরিহার করুন
ধূমপান শ্বাসনালীর প্রধান শত্রু। এটি ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা ও ফুসফুস ক্যানসারের অন্যতম কারণ।
২. পরিচ্ছন্ন বাতাস নিশ্চিত করুন
পরিবেশ দূষণ ও ধুলাবালি থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক ব্যবহার করুন এবং ঘর-বাড়ির বায়ু পরিশুদ্ধ রাখুন।
৩. স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করুন
ভিটামিন C ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার শ্বাসনালীর কার্যকারিতা বাড়ায়।
৪. ব্যায়াম করুন
নিয়মিত ব্যায়াম, বিশেষ করে অ্যারোবিক এক্সারসাইজ (যেমন হাঁটা, দৌড়ানো), ফুসফুসের কার্যকারিতা বাড়ায়।
৫. পানি পান করুন
প্রচুর পানি পান করলে শ্বাসনালী শুষ্ক হয় না এবং শ্লেষ্মা সহজে বের হয়ে যায়।
৬. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
যদি দীর্ঘমেয়াদি কাশি, শ্বাসকষ্ট বা বুকে ব্যথা অনুভব করেন, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
উপসংহারঃ
শ্বাসনালী আমাদের দেহের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সঠিকভাবে কাজ না করলে মারাত্মক শ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই শ্বাসনালীর স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতন থাকা প্রয়োজন। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখার মাধ্যমে শ্বাসনালীর কার্যকারিতা উন্নত করা সম্ভব।